মাছের আবাসস্থল হচ্ছে জলাশয়। বাংলাদেশ প্রকৃতিগতভাবেই জলাশয় সম্পদ উৎস। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের চারটি উৎস রয়েছে।

১. অভ্যন্তরীয় মুক্ত জলাশয়।

২. অভ্যন্তরীয় বদ্ধ জলাশয়।

৩. আধালোনা পানির জলাশয়।

৪. সামুদ্রিক জলাশয়।

চলো এবার এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।

অভ্যন্তরীয় মুক্ত জলাশয়

সমুদ্র ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে যেসব জলাশয় রয়েছে সেগুলোকে অভ্যন্তরীয় মুক্ত জলাশয় বলা হয়। বাংলাদেশে মোট অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় সংখ্যা হচ্ছে ৩৮,৬৬,০৯১ হেক্টর (তথ্য সূত্র->কৃষি ডায়েরি ২০২২)। বিভিন্ন ধরনের মুক্ত জলাশয়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তোমাদেরকে প্রদান করা হলো।

মাছের
মাছের

(ক) নদনদী ও মোহনা:

নদ নদী ও মোহনা হল অনেক মাছেরে প্রকৃতি প্রজনন ক্ষেত্র বা আবাসস্থল। নদ-নদী ও মোহনা অঞ্চল থেকে প্রতি বছর প্রচুর মাছ উৎপাদিত হয়। মাছের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মিশ্রণ থাকে তবে এতে ইলিশ মাছের পরিমাণই সর্বাধিক। বাংলাদেশের নদনদী ও খাড়ি অঞ্চলে মোট আয়তন ৮,৫৩,৮৬৩ হেক্টর। রুই জাতীয় মাছ এসব নদ-নদীতে প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে পোনা ছাড়ে।

(খ) সুন্দরবন:

বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাঘেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা জুড়ে সমুদ্র উপকূলীয় নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হল সুন্দরবন।ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে বনটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে।বনটি বাংলাদেশ এবং ভারতে বিস্তার লাভ করেছে তবে বেশিরভাগ অংশই বাংলাদেশের। বনটির ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া অসংখ্য নদ-নদী খারি খাল বিল মিলে তৈরি করেছে একা জলাকীর্ণ অঞ্চল যার আয়তন ১ লক্ষ ৭৭ হাজার ৭০০ হেক্টর বা এরা কিছু বেশি (তথ্যসূত্র কৃষি ডায়েরী ২০২২)।

(গ) বিল

বিল প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট জলাশয়। অন্যভাবেও বলা যায় যে বিল হল প্লাবন ভূমির গভীরতম অংশ যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলায় বিল রয়েছে।এ ধরনের জলাশয়ের মোট আয়তন ১,১৪,১৬১ হেক্টর (তথ্যসূত্র কৃষি ডায়েরি ২০২২)।চালন বিল বাংলাদেশের সব থেকে বড় বিল। বিলে বসবাসকারী মাছের মধ্যে রয়েছে রুই জাতীয় মাছ বোয়াল এবং অন্যান্য ছোট প্রজাতের উল্লেখযোগ্য মাছ। বর্ষাকালে নদীতে বন্যা হয় তখন নদী আর বিল মিশে একাকার হয়ে যায়। এসময় অনেক মাছের নদী থেকে বিলে বিচারণ করে বন্যা নেমে গেলে অনেক মা আছে বিলের ভিতর আটকা পড়ে যায় এবং সেখানেই বড় হতে থাকে।

আবাসস্থল ও জলাশয়
আবাসস্থল ও জলাশয়

(ঘ) প্লাবনভূমি


বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যা ও বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়। প্লাবন ভূমিতে ৩-৬ মাস পানি আটকা থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় মাছ এসব প্লাবনভূমিতে বিচরণ করে, বংশ বিস্তার করে এবং মাছের সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। প্রতি বছর প্রায় ২৬,৫১,৫৬৭ হেক্টর জমি বন্যা ও বৃষ্টিতে প্লাবিত হয় (তথ্যসূত্র-কৃষি ডায়েরি-২০২২)।

Read More:ইন্টারনেটর ধারণা মানবতার জন্য নতুন যুগের সূচনা 2024

অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়:


বাংলাদেশে মোট অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় ৮,৩৬,৭৯৬ হেক্টর। বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে পড়েছে পুকুর, দিঘি, বাঁওড়, উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়ি খামার ও মৌসুমি জলাশয় (তথ্যসূত্র-কৃষি ডায়েরি-২০২২)

(ক) পুকুর

পুকুর হলো স্থির পানির ক্ষুদ্র জলাশয় যার চতুর্দিকে উঁচু পাড় থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে পুকুর খনন করা হতো বিশেষত দৈনন্দিন পানির চাহিদা মেটানো এবং গোসল করার জন্য। বর্তমানে দেশে ছোট, বড় মাঝারি, মৌসুমি সব ধরনের পুকুরেই মাছ চাষ করা হয়। আমাদের দেশে ১৩ লক্ষাধিক পুকুর দিঘি রয়েছে যার মোট আয়তন ৪,০৪,৪৯৭ হেক্টর (তথ্যসূত্র-কৃষি ডায়েরি-২০২২)।

(খ) বাঁওড়

নদীর বাঁকে । আকৃতির জলাশয় যা নদীর মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তাকেই বাঁওড় বলা হয়। দেশের অধিকাংশ বাঁওড়ই বৃহত্তর যশোর, কুষ্টিয়া এবং ফরিদপুরে অবস্থিত। অধিকাংশ বাঁওড়েই রুই জাতীয় মাছের পোনা ছেড়ে চাষ করা হয়। বাঁওড় জলাশয়ের মোট আয়তন ৫৬৭১ হেক্টর।

(গ) উপকুলীয় চিংড়ি খামার

সমুদ্রের নিকটবর্তী যে-সব অঞ্চলে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে সেখানে এ খামারগুলো অবস্থিত। উপকূলবর্তী এলাকাসমূহের জমিতে জোয়ারের পানি আটকিয়ে রেখে সেখানে চিংড়ি চাষ করা হয়। এসব জলাশয় চিংড়ি ঘের নামে পরিচিত। এসব ঘেরে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হয়। জোয়ারের সময় সমুদ্রের পানি মোহনা দিয়ে জমির কিছু দূর পর্যন্ত প্রবেশ করে। এসব জলাশয়কে খাঁড়ি বলে। খাঁড়ি অঞ্চলের মাছগুলো হলো ভেটকি, ইলিশ, চিংড়ি ইত্যাদি। উপকূলীয় চিংড়ি খামারের মোট আয়তন ২,৫৭,৮৮৮ হেক্টরের কিছু বেশি।

আবাসস্থল ও জলাশয়

(ঘ) মৌসুমি জলাশয়

এ ধরনের জলাশয়ে শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমে অল্পদিনের জন্য পানি থাকে। ধানক্ষেত, পগার ইত্যাদি মৌসুমি জলাশয়ের শ্রেণিভুক্ত। মৌসুমি জলাশয়ের মোট আয়তন ১,৫১,৯৪২ হেক্টর (তথ্যসূত্র-কৃষি ডায়েরি-২০২২)। এ ধরনের জলাশয়ে সাধারণত ছোট মাছ পাওয়া যায়। ৩। আধা লোনা পানির জলাশয়ঃ নদী ও সমুদ্রের সঙ্গমস্থলকে আধা লোনা পানির জলাশয় বলা হয়। এ অঞ্চল নদী ও সমুদ্র বাহিত পুষ্টিকারক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। একটি দেশের আধা লোনা পানির জলাশয় ঐ দেশের যে-কোনো জলাশয়ের তুলনায় অধিক উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন। আধা লোনা পানির জলাশয় চিংড়ি চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। আমাদের দেশে বর্তমানে ব্যাপক হারে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। চিংড়ি চাষের জন্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও কক্সবাজার
উপকূলীয় জেলাসমূহে আধা লোনা পানির জলাশয় বিস্তৃত।

সামুদ্রিক জলাশয়

বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বিশাল সামুদ্রিক এলাকা যেখানে ৭১০ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ উপকূল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত রয়েছে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল। সমুদ্রের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বাস করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ইত্যাদি। সামুদ্রিক এলাকায় মাছ চাষ করা হয় না। শুধুমাত্র সমুদ্র থেকে মাছ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রাণী আহরণ করা হয়।

২০১৯-২০ অর্থ বছরে সামুদ্রিক জলাশয় থেকে ৬,৭১,১০৪ মেট্রিক টন মৎস্য আহরিত হয়েছে। পৃথিবীর ভূখণ্ডগত সম্পদ কমার সাথে সাথে মানুষ এখন সমুদ্রমুখী হচ্ছে। পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রই এখন সমুদ্রের ওপর তার অধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ যথাক্রমে জার্মানির হামবুর্গ এ অবস্থিত I

TLOS (International Tribunal for the Law of the Sea)-এর মাধ্যমে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে এবং নেদারল্যান্ডের হেগের “স্থায়ী সালিসি আদালত” (The Permanent Court of Arbitration at the Hauge)-এর মাধ্যমে ২০১৪ সালে ভারতের সাধে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করে যথাক্রমে ১,১১,৬৩১ এবং ১৯,৪৬৭ বর্গকিলোমিটার নতুন সমুদ্র এলাকায় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠান করে।

ফলে এই বিশাল সমুদ্র এলাকার সকল প্রকার প্রাণিজ (মাছসহ অন্যান্য প্রাণী) এবং অ-প্রাণিজ (তেল, গ্যাস ইত্যাদি) সম্পন উত্তোলন, আহরণ এবং ব্যবহারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এখানে একটি বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার।

আবাসস্থল ও জলাশয়
আবাসস্থল ও জলাশয়

তাহলো বিরো নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ খাতা কলমে তটরেখা (Baseline) থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল বিস্তৃত একান্ত অর্থনৈতিক এলাক দাবী করলেও বাস্তবে ১৩০ নটিক্যাল মাইলের উপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। এখন বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে পুরোপু ২০০ নটিক্যাল মাইলের ওপর বাংলাদেশের অধিকার সংরক্ষিত হলো। শুধু তাই নয়, এ রায়ের ফলে ২০০ নটিক্যাল মাইলে বাইরেও মহীনসোপানে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।