মৎস্য সম্পদ

বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন, পুষ্টি সরবরাহ, কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মৎস্যসম্পদ, মাছ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জাতীয় আয়ের শতকরা প্রায় ৩.৫২ ভাগ এবং কৃষি সম্পদ হতে আয়ের শতকরা ২৬.৩৭ ভাগ আসে মৎস্যসম্পদ থেকে (তথ্যসূত্র-কৃষি-ডায়েরি-২০২২)।

প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত কারণে বাংলাদেশে মৎস্য উৎপাদনের বিস্তৃত ক্ষেত্র রয়েছে। মৎস্যসম্পদ জরীপ অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৭,০২,৮৮৭ হেক্টর, এর মধ্যে প্লাবনভূমিসহ মুক্ত জলাশয় ৩৮,৬৬,০৯১ হেক্টর এবং উপকূলীয় চিংড়ি খামারসহ বদ্ধ জলাশয় ২,৫৭,৮৮৮ হেক্টর (তথ্যসূত্র: কৃষি ডায়েরি-২০২২)।

মাছ
মাছ

Read More:মাছের আবাসস্থল ও জলাশয়

তটরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত একান্ত অর্থনৈতিক এলাকাসহ (exclusive economic zone) সামুদ্রিক জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ১.৬৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। এত বিস্তৃত জলাশয় থাকা সত্ত্বেও, ১৯৬২ হতে ১৯৮০ সালের মধ্যে মানুষের দৈনিক মাথাপিছু মাছের প্রাপ্তি ৩৩ গ্রাম হতে ২০ গ্রামে হ্রাস পায়। পুষ্টিমান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নাছ চাষের গুরুত্ব অপরিসীম।

পুষ্টিমান উন্নয়নে মাছ:

“মাছে ভাতে বাঙালি” প্রবাদ বাক্যের সত্যতা এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এক সময় ছিল যখন এদেশের মানুষের খাদ্য তালিকা প্রধান ও আবশ্যিক উপাদান হিসেবে স্থান পেত। জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং শস্য পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে মাছের বিচরণ ক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ার ফলে বর্তমানে মাথাপিছু ভক্ষণের হার অনেক কমে গেছে।

পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, একজন বাংলাদেশীর প্রতিদিন কমপক্ষে ৪৫.৩ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত। এর মধ্যে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ (১৫.১ গ্রাম) হবে প্রাণিজ প্রোটিন। বাংলাদেশে প্রাণিজ প্রোটিনের শতকরা ৮০ ভাগ আসে মাছ জাতীয় দ্রব্য থেকে। অর্থাৎ ১২ গ্রাম প্রোটিন আসে মাছ থেকে। এতে শতকরা ১৬.৫ ভাগ প্রোটিন থাকে।

তাহলে ১২ গ্রাম প্রোটিন পাওয়ার জন্য ৭৩ গ্রাম মাছ প্রতিদিন খেতে হবে। অথচ বর্তমানে ভক্ষণের গড় হার মাত্র ৩৬ গ্রাম। একমাত্র উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করেই কেবল ঘাটতি মেটানো এবং পুষ্টিমান উন্নয়ন সম্ভব।

মাছ
মাছ

কর্মসংস্থান বৃদ্ধিঃ

বর্তমানে বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৮ জন লোক মাছ ধরা কাজের সঙ্গে জড়িত আছে। উন্মুক্ত জলাশয় এবং মোহনা ও গভীর সমুদ্র থেকে আহরণ করেই এসব লোক জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তবে বিভিন্ন কারণে প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি হওয়াতে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরার পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।

তাই এ সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগও কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য পুকুর-ডোবা আছে। এদের অধিকাংশ পরিত্যক্ত অবস্থায় বা অনিবিড় চাষের অন্তর্ভুক্ত। নিবিড় চাষ কৌশল প্রয়োগ করলে মাছের উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেত। নিবিড় চাষ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর জনশক্তি প্রয়োজন হবে। আর এভাবেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করার জন্য মাছ চাষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন:

তৈরি পোশাক ও জনশক্তির পরে মাছই প্রধান দ্রব্য যা থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের শতকরা ৫ ভাগ আসে মাছ জাতীয় পণ্য যেমন চিংড়ি রপ্তানি থেকে। বাংলাদেশে মাছ চাষের যে সম্ভাবনা রয়েছে তাকে কাজে লাগিয়ে চাষ জোরদার করতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন:

বাংলাদেশে গ্রামে গঞ্জে অসংখ্য পুকুর ছড়িয়ে আছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে পুকুরের সংখ্যা ১২ লক্ষ ৮০ হাজার যার মোট আয়তন ১৫ লক্ষ হেক্টর। এসব পুকুরে শতকরা ৫৫ ভাগ মাছ চাষের আওতায় আনা হয়েছে এবং শতকরা আরও ৩০ ভাগ মাছ চাষের আওতায় আনা সম্ভব। বাকি ১৫ ভাগ পতিত।

পতিত বা আপাত চাষ যোগ্য এসব পুকুরের মালিকানা দেশের প্রান্তিক চাষি বা বিত্তহীনদের হাতে। সংস্কারের মাধ্যমে এসব পুকুরে মাছ চাষ করে বিত্তহীন লোকদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। কাজেই বাংলাদেশে মাছ চাষের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

মাছ
মাছ

হাঁস-মুরগির খাদ্য :

বাংলাদেশে হাঁস-মুরগির চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে এদের খাদ্যের চাহিদা। মাছের অব্যবহৃত অংশ যেমন- আঁইশ, কাটা, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি এবং ফিসমিল (Fishmeal) দ্বারা হাঁস-মুরগির জন্য উত্তম সুষম খাদ্য তৈরি করা সম্ভব। এসব আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য হাঁস-মুরগিকে খাওয়ালে ডিম ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

পতিত জমির সদ্ব্যবহার:

পতিত/অব্যবহৃত জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করলে পারিবারিকভাবে মাছের চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে আর্থিকভাবেও কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে।মৎস্য চাষ ব্যবস্থাপনা কাজেই উপরের আলোচনা থেকে এটা বলা যায় যে, বাংলাদেশে মাছ চাষের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

Categorized in:

News,

Last Update: March 27, 2024